Krishi Vigyan Kendra, Cachar, Assam Agricultural University

ঘরে তৈরি কীটনাশক ঔষধের প্রস্তুত এবং প্রয়োগ প্রণালী

শস্যর অনিষ্টকারী পোকা এবং রোগ নিয়ন্ত্রনের জন্য কৃষকরা সাধারণতে বাজারে পাওয়া কৃষি রাসায়নিক ঔষধের উপর নির্ভর করে। কিন্তু বহুক্ষেত্রে দেখা যায় যে কিছু সংখ্যক প্রয়োজনীয় কৃষি ঔষধ বাড়িতে প্রস্তুত করা সম্ভব আর এই ঔষধ কার্যকারী হওয়া ছাড়াও তুলনামুলাভাবে খরচা কম। উদ্ভিদজাত এবং অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে প্রস্তত করা কয়েকটি ঔষধের প্রস্তত প্রণালী এবং ব্যবহার সম্বন্ধে উল্লেখ করা হল। নিমের প্রয়োগ –নিম গাছের প্রত্যেকটি অংশ শস্য সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করতে পারা যায়। কীটনাশক, কীট বিকর্ষক, ছত্রাক(ভেকুর) নাশক এবং শস্য ক্রিমি নিয়ন্ত্রনের জন্য নিম প্রয়োগ করিয়া ভাল ফল পাওয়া যায়। নিম দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা শস্য অনিষ্টকারী কীটগুলি হল মোয়া পোকা,শোহানী পোকা, পাতা খাওয়া পোকা, মাজরা পোকা, ফরিং, রাইছ ঊইভিল এবং অন্যান্য কোমল শরীরের পোকা ।
নিমের ফল চার প্রকারে প্রয়োগ করা যায় ।

ক) নিম ফলের রস
খ) নিম তেল
গ) নিম ফলের গুড়া ঘ) নিম ফলের খইল । তাদের প্রত্যেকের প্রয়োগ আলাদা ধরণের হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হল। প্রয়োগ বিধি :
  • ২০-২৫ গ্রাম নিমের ফল গুড়া করে কাপড়ের পু্টলির মধ্যে বেধে এক লিটার জলে এক রাত্রি পর্য্যন্ত ডুবিয়ে রাখুন। পরের দিন এই জল শাক সব্জি পাতা খাওয়া এবং ফরিং নিয়ন্ত্রনর জন্যে ব্যবহার করুন।
  • ৫ কিঃ গ্রাঃ নিম ফলের শুকনো গুড়া কাপড়ের মধ্যে বেধে ১০০ লিটার জলে ডুবিয়ে রাখুন। পরের দিন কাপড়ের পু্টলিটা ভালভাবে চেপে তুলে নিন আর সেই ১০০ লিটার জলের সঙ্গে ১০ গ্রাম সাবানের ঘোল মিশিয়ে প্রয়োগ করুন।
  • নিম ফলের গুড়া শস্যের ভারালে রাখলে রাইছ উইভিল এবং অন্য পোকার আক্রমণ কম দেখা যায়।
  • ভারালে রাখা সীমের বীজ সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রতি কিঃ গ্রাঃ বীজের সঙ্গে নিম তেল প্রয়োগ করুন।
  • বেগুন গাছের ছিদ্রকারি পোকা, টমেটো গাছের শস্য ক্রিমি এবং পাতার দাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি হেক্টর ২ টন নিমের খইল ব্যবহার করুন।
  • লেবু গাছের পাতা খাওয়া পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম ফলের খইল জলের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করুন।
  • ভৰালে ধান, গম, দাল জাতীয় শস্যৰ বীজ সংৰক্ষণ কৰাৰ সময় নিমেৰ পাত চিতিয়ে ৰাখিলে ইহার গোন্ধে বীজ অনিষ্টকাৰী পোকার ক্ষেত্রে বিকর্ষক হিচাপে কাজ কৰে। এছাড়া নিমের পাতা বীজাণুনাশক, পৰজীৱীনাশক আৰু ভেকুৰনাশক গুণেৰ আধিকাৰী হওয়াই ই ভৰালেৰ সংৰক্ষিত বীজ অনিষ্টকাৰী পোকার আক্রমণ থেকে সুৰক্ষিত কৰে এবং নষ্ট হইতে দায়ে না।
  • ধান খেতে শেষ বাৰ হাল দেওয়ার সময় তাজা নিমৰ পাতা বিঘাই প্রতি ৫-১০ কেঃ জিঃ চিতিয়ে নিতে লাগে। এই নিম পাতার গোন্ধ এবং ওষুধি গুণে কীট বিকর্ষক হিচাবে কাজ কৰে।
হলুদের প্রয়োগঃ হলুদের ব্যবহার এবং ঔষধি গুনাগুন সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। হলুদ ব্যবহার করে বিভিন্ন শস্য অনিষ্টকারী পোকা যেমন বিছা পোকা, ডাল ছিদ্রকারী পোকা, মাইট, রাইছ উইভিল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রয়োগ বিধিঃ
ক) হলুদ আর এবং গৌ মুত্র এক সঙ্গে পিষে জলের সঙ্গে ১:২ অনুপাতে মিশিয়ে বিছা পোকা প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োগ করুন ।
খ) হলুদের রসে একটা লম্বা মরাপাটের ডরি ভাল করে ডুবিয়ে পাথারে করে ডরির দুই মাথায় ধরে খেতের ওপরে টেনে নিয়ে গেলে অনিষ্টকারী পোকা দূর হয়ে যায়।
রসুনের ঘোলঃ কীটনাশক, ব্যাকটেরিয়া নাশক, কীট বিকর্ষক,শস্য ক্রিমি নাশক রূপে রসুন ব্যবহার করিয়া সুফল পাওয়া যায়। ফল গাছের বিছা পোকা নিবারণের জন্য রসুনের ঘোল অতি ফলদায়ক। প্রয়োগ বিধিঃ
ক) দুটো গোটা রসুন ,দুই চা চামচ লঙ্কার গুড়া এবং ৫০ গ্রাম সাবান চার লিটার জলে মিশিয়ে গাছে প্রয়োগ করলে বিছা পোকা নিবারণ করতে পারা যায়।
খ) তিনটি গোটা রসুন ভালভাবে পিষে ২ দিন পর্য্যন্ত রাখার পরে বড় পাত্রে ১০০ গ্রাম সাবান ১০ লিটার জলে মিশিয়ে শস্যে প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
গ) ১০০ গ্রাম রসুনের রোয়া ভালভবে পিষে ২৪ ঘণ্টা পর্য্যন্ত রেখে দিন। তারপর আধা লিটার জলে ১০ গ্রাম সাবান, ২ চা চামচ কেরাসিন মিশিয়ে তার সঙ্গে পূর্বে তৈয়ার করা রসুনের মণ্ডটি মিশিয়ে মিশ্রণটি ভালভাবে ছেকে নিয়ে প্রয়োগ করুণ।

গৌ মুত্রঃ শস্য অনিষ্টকারী বিভিন্ন পোকা এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য গৌ মুত্র ব্যবহার করিয়া ভালফল পাওয়া যায়। শস্য অনিষ্টকারী কোমল শরীরের পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য গৌ মুত্র অতি ফলদায়ক।
প্রয়োগ বিধিঃ
গৌ মুত্র দুই সপ্তাহ রাখার পরে ছয় গুণ জলের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করুণ । বিষাণু (ভাইরাস) জনিত রোগ নিরাময়ির জন্য মিশ্রণটি সপ্তাহে ২-৩ বার প্রয়োগ করা দরকার। এর উপর হলুদ, নিম বা বাশক পাতা এবং সাধা পাতা গৌ মুত্রর সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায় ।
ছাইঃ ক) আধা কাপ ছাই, আধা কাপ চুন ৮ লিটার জলে ভালভাবে মিশিয়ে কয়েক ঘণ্টা রাখার পরে ছেকে লাউজাতীয় ফসলে প্রয়োগ করুণ।
খ) চুষে খাওয়া পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৬ চা চামচ কেরাসিন, ১ কেজি ছাইর সঙ্গে মিশিয়ে সপ্তাহে ২ বার সকালে শাক সব্জিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করার দরকার।
গ) পাতা খাওয়া পোকা দমনের জন্য শুকনো ছাই শাক সব্জির খেতে প্রয়োগ করুণ।
ঘ) ১ লিটার জলে, ১চা চামচ কাঠের ছাই মিশিয়ে এক রাত্রি রাখার দরকার। তারপরে এই মিশ্রণটি ১ কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে ছেকে নিয়ে আবার ৩ গুন জলের সঙ্গে মিশিয়ে পাউদারিমিল্ডউ এবং জলসা(ব্লাষ্ট) রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োগ করুণ।
 
সাধা পাতা (তামাক পাতা) সাধা পাতের মিশ্রণ কোমল-শরীরের পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। বিভিন্ন শস্য,যেমন– লেবু, সরিসা, আলু, লঙ্কা, লাইশাক, বান্ধাকবি ইত্যাদিতে আক্রমণ করা মোয়া পোকা, গম এবং বরবটির রাষ্ট, ছএাক জনিত রোগ, লিফকার্ল ভাইরাস এবং টমেটো, বেগুন গাছের আগা আর ফল খাওয়া পোকা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধা পাতার মিশ্রণ প্রয়োগ করে বিশেষ সুফল পাওয়া যায়।
প্রয়োগ বিধিঃ
ক) ১ কিঃ গ্রাঃ সাধা পাতা এবং থারি ১৫ লিটার জলে মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা পর্য্যন্ত রাখার পরে তার সঙ্গে ২৫০ গ্রাম সাবান(ডিটারজেন্ট) ভালভাবে মিশানর পরে মিশ্রণটি ছেকে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
খ) ধান গাছের মাঝে ধপাতের ডাল ২৫০-৩০০ কিঃ গ্রাঃ প্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করিয়া মাজরা পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রয়োগের সময় খেতে ৫ সেঃ মিঃ বন্ধ জল থাকার দরকার।
কেরচিন তেল আর জলের মিশ্রণঃ৫০০ গ্রাম কাপড় ধোয়া সাবান খুব পাতল ভাবে কেটে নিয়ে ৪.৫ লিটার জলে রেখে ভালভাবে মিশে না যাওয়া পর্য্যন্ত গরম করুন। তারপরে মিশ্রণটি ঠাণ্ডা করে ৯ লিটার কেরাসিন মিশান। প্রস্তুত হওয়া মিশ্রণের একভাগের সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ভাগ জল মিশিয়ে স্প্রে করুন। গাছের রস চুষে খাওয়া পোকা যেমন মোয়া পোকা,গান্ধী পোকা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই মিশ্রণ বিশেষভাবে কার্যকারী। ইহার উপর ধানের চুঙ্গী পোকা(Case worm) আর মরাপাটের চেমিলুপার, বিছা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা যায়।
হিং আর হলুদের মিশ্রণঃ হিং গুড়া ১.৫ গ্রাম আর ৫ হলুদের গুড়া ৫ গ্রাম অল্প জলের সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে নিন। এখন এই মিশ্রণটি ১০ লিটার জলে মিশিয় প্রয়োগ করুণ। এই ঔষধ টমেটো ,বেগুন এবং আলুর ব্যেক্টেরীয়াজনিত ধলে পরা রোগ নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রতি গাছে ৩ লিটার হারে গাছ রোয়ার ১০, ২০,৩০ আর ৪০ দিনের অন্তরে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। এই ঔষধ তৈরি করার সময় হিং এর মাত্রা সঠিক রাখার প্রয়োজন । হিং এর মাত্রা অধিক হইলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়।  
বেল পাতার মিশ্রণঃ তাজা বেল পাতা ৩৭৫ গ্রাম ভালভাবে পিষে ১৫ লিটার জলের সঙ্গে মিশানোর পর ছেকে নেন। এখন এই মিশ্রণ ফসলে সকাল বেলা প্রয়োগ করলে ব্লাষ্ট রোগ নিয়ন্ত্রিত হয়।
তুলসী পাতার মিশ্রনঃ তাজা তুলসী পাতা ৩৭৫ গ্রাম নিয়ে সমপরিমানের জলের সঙ্গে ২০ মিনিট সময় পর্যন্ত ফুটান। এই মিশ্রণটি ছেকে নিয়ে ১৫ লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে সকালে স্প্রে করুন।ধান গাছের ব্লাষ্ট রোগের জন্য উপকারী।

 
পঞ্চ পাতার মিশ্রণঃ শুকনো সাধা পাতা ১০০ গ্রাম আর তাজা আকন্দ, আম্রা, নিম এবং সীতাফল গাছের পাতা প্রত্যেকটির ৫০০ গ্রাম এক সঙ্গে পিষে নিয়ে ৫ লিটার জলে ডুবিয়ে৭-১০ দিন পর্যন্ত ঢ়েকে রাখুন। এর পর ৫ লিটার গৌ মুত্র আর ৫ লিটার জল মিশ্রণটির সঙ্গে মিশান। মিশ্রণটি ফুটিয়ে জলের পরিমান অর্ধেক করিয়া ঠাণ্ডা হওয়ার পরে ছেকে নেন। এই মিশ্রণের ৩-৪ মিঃ লিঃ ১ লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করুণ। এই জৈবিক কীটনাশক সমস্ত পাতা খাওয়া পোকার নিয়ন্ত্রণে দারুন কাজ করে।